আবেগ (Emotion), ভাবপ্রবণতা (Sentiment) এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ

Image by Gordon Johnson from Pixabay
Emotion অর্থাৎ আবেগ এবং Sentiment অর্থাৎ ভাবপ্রবণতা দুটি এমন শব্দ যা আমাদের জীবনের সাথে
ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত। আবেগী মন কে নিয়ন্ত্রণ করা সম্পর্কে অনেকের অনেক মতামত আছে, কিন্তু এই বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা অন্য রকম। আমি বরাবর একটু ভাবুক প্রকৃতির ছেলে। সামান্য কথায় অনেক উচ্চ চিন্তা ভাবনায় চলে যেতাম। কিন্তু এই বিশেষ ব্যবহার আমার কাছে আশীর্বাদ না অভিশাপ তা বুঝলাম যেদিন আমার এক বন্ধু কে ধীরে ধীরে পালটে যেতে দেখলাম। তার সাথে আমার পরিচয় স্কুল থেকেই, আমরা দুজনেই ঠিক করি আমরা গণিত নিয়ে পড়াশোনা করবো। সেই মতো আমরা কলেজের ফর্মও ফিলাপ করি। আমাদের মধ্যে বরাবরই চিন্তা আদান প্রদান হত। সে তার নানান চিন্তার কথা আমাকে বলতো আমিও তাকে আমার নানা আবিষ্কারের কথা শোনাতাম। কিভাবে এক ফর্মুলার মধ্যে অন্য ফর্মুলা বসিয়ে নতুন ফর্মুলা বানানো যায়, কি করে আমরা নানা গ্রাফের ছবি আঁকতে পারি এবং তাদের দ্বারা দ্বিঘাত সমীকরণের বীজ সম্পর্কে ধারণা করা যায় এইসব। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমরা আলাদা স্যারের কাছে টিউশন পড়তাম। যার বাড়ি যে স্যারের কাছে ছিলো সে তার কাছেই পড়তো। আমি খেয়াল করতে থাকি আমার পড়াশোনার অগ্রগতি তার কাছে যেন এক দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে উঠছে। স্যার কোনো প্রশ্ন করতেই সে (খুবই তাচ্ছিল্যের সাথে) বলতো "হ্যাঁ ও-ই পারবে স্যার, জিজ্ঞেস করুন।" এরকম কথা আমি এর আগে কখনো শুনিনি। তার এইরকম ব্যবহারে আমার মনে হতে থাকে আমার গণিতের প্রতি আবেগ ওর মনে বিপরীত চিন্তার সৃষ্টি করছে। অতিরিক্ত ভাবুক হওয়ার দরুন আমার প্রতিটি আচরনের প্রতি ও বিরূপ ব্যবহার প্রকাশ করছে। এই দেখে আমার রাগ হলেও কোনোরকমে সামলে নিতাম, ভাবতাম একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যত দিন যায় তত আচরণ খারাপ হতে থাকে। প্রথম বছরের শেষের দিকে আমরা এক বেঞ্চে বসতাম না। কলেজের দ্বিতীয় বছরে সে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেয়ে চলে যায়, তারপর থেকে আর কোন যোগাযোগ নেই। পরবর্তী কালে জানতে পারি আমি যে স্যারের কাছে পড়তাম সে নাকি ভালো নোট লেখাতো এই ধারণা থেকে তার মধ্যে হিংসার জন্ম নেয়। ছোটোবেলায় বাবা আমাকে একটা সংস্কৃত শ্লোক খুব সুন্দর করে শোনাতেন

"যস্য নাস্তি স্বয়ং প্রজ্ঞা শাস্ত্রং তস্য করোতি কিম।
লোচনাভ্যং বিহীনস্য দর্পন কিম করিষ্যতি।।"

এর অর্থ যে ব্যাক্তির নিজের উপর কোনো প্রজ্ঞা বা নিজেকে বোঝবার কোনো ক্ষমতা নাই শাস্ত্র তার কী করবে? নেত্র বিহীন মানুষের আয়না কোন কাজে দেয়? ছোটবেলায় এই শ্লোকের মানে না বুঝলেও এখন বুঝতে পারি। এতদিনের পুরনো বন্ধু কে হারানোর জন্য তখন আমি খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। কিভাবে যে সেই ভার এতদিন নিয়েছিলাম কে জানে। ২০২০ সালে গৃহবন্দি থাকাকালীন যখন ভাগবত গীতা পড়তে শুরু করি তখন কিছু শ্লোক আমার মনের ভিতরের অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয় যার মধ্যে প্রধান হল, ষষ্ঠ অধ্যায়ের শ্লোক ৩৪-৩৫। সম্ভবত, আদর্শ যোগী কেমন হয় বলতে গিয়ে মাধব অর্জুন কে বলেন নিজের মন কে বশীভূত করতে হবে, মন আমাকে নয় বরং আমি মন কে পরিচালিত করবো। একথা শুনে অর্জুন বলে,
"চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্‌দৃঢ়ম।
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্‌।"

অর্থাৎ হে কৃষ্ণ, এ মন প্রবল আলোড়ন (প্রমথন) স্বভাব যুক্ত, একে নিয়ন্ত্রনে আনা (দমন করা/নিগ্রহ করা) বায়ুকে দমন করার সমান। এর উত্তরে মাধব বলেন,

"অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্‌।
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে।।"

এর অর্থ, অর্জুন (অপর নাম মহাবাহো) তুমি যা বলছো তাতে আমার কোন সংশয় নেই, মন কে নিগ্রহ করা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। অভ্যাসের দ্বারা তুমি গৃহে থেকেই মন কে সংযম (বৈরাগ্য লাভ) করতে পারবে।

এই শ্লোক পড়ে আমি বুঝেছি আমার এই মনের কষ্ট ততদিন যাবে না যতদিন আমি নিজের মন কে নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় যখন অধ্যাপক শ্যামল কুমার হুই আমাকে স্বামী বিবেকানন্দের লেখা আমার ভারত অমর ভারত পড়তে বলেন, তখন সেখানেও আমি একই রকম একটি কথা পাই,

অধ্যায় - প্রকৃত ধর্ম, নং - ৩৯,

"ঠিকভাবে কাজ করতে হলে প্রথমেই আসক্তির ভাব ত্যাগ করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ হৈ চৈ-পূর্ণ কলহে নিজেকে জড়িও না; নিজে সাক্ষিস্বরূপ অবস্থিত থেকে কাজ করে যাও। আমার গুরুদেব (শ্রীরামকৃষ্ণ) বলেছেন, 'নিজের সন্তানদের উপর দাসী বা ধাত্রীর ভাব অবলম্বন করো। দাসী তোমার শিশুকে নিয়ে আদর করবে, তার সঙ্গে খেলা করবে, খুব যত্নের সঙ্গে লালন করবে যেন তার নিজের সন্তান; কিন্তু দাসীকে বিদায় দেওয়ামাত্র সে গাঁটরি বেঁধে তোমার বাড়ি থেকে চলে যেতে প্রস্তুত। এত যে ভালোবাসা ও আসক্তি, সবই সে ভুলে যায়। ...তুমিও যা কিছু তোমার নিজের মনে কর, সে-সবের প্রতি এরকম ভাব পোষণ করো। তুমি যেন দাসী, আর যদি ঈশ্বরে বিশ্বাসী হও তবে বিশ্বাস কর যা কিছু তোমার বলে মনে কর, সবই তাঁর।"

এই খানে কবীরের একটি দোঁহা মনে পড়ে গেলো,

"কবীর খড়া বাজার মেঁ, মাঙ্গে সবকী খ্যার,
না কাহু সে দোস্তি, না কাহু সে ব্যার।"

মানে, কবীর বাজারে দাঁড়িয়ে সবার জন্য মঙ্গল কামনা করছে, তার ফলে না সে কারও বন্ধু হবে না কারোর শত্রু। মন কে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অনেক রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যার মধ্যে প্রধানত হল প্রেম। এটি মনুষ্য জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। সমস্ত মানুষই তার জীবনের কোনো-না-কোনো পর্যায়ে প্রেমের সম্মুখীন হয়েছে। মান্না দে-র ভাষায়, "হৃদয় আছে যার সেই তো ভালবাসে, প্রতিটি মানুষেরই জীবনে প্রেম আসে।" তবে যদি এটা অপরিহার্য-ই হয়ে থাকে তবে এর জন্য এত মনঃকষ্ট কেন হয়? প্রেম করলে এত যন্ত্রণা কোথা থেকে আসে? এর কারণ হল, ইমোশান ও সেন্টিমেন্ট। যদি একদম গোড়া থেকে দেখা হয় তবে বোঝা যাবে যে প্রায় সমস্ত প্রেমের সূত্রপাত হয় একটা মন গলানো মুখ থেকে। যে মুখ ও চোখ কে ভোলা যায় না। সারাদিন ধরে সেই মুখটা মনে পড়ে, The Conjuring সিনেমার ভাষায় এটাকে বলে Infestation অর্থাৎ সংক্রমণ। শুরু হয় সেই মুখের মালিক বা মালকিনের নাম-ঠিকানা-ফোন-ফেসবুক-ইন্সটাগ্রাম খোঁজা। মন ক্রমশ একাগ্র হতে শুরু করে সেই সব তথ্য জোগাড় করতে। এরপর আসে Oppression বা উৎপীড়ন, যখন তথ্য না পাওয়ার জন্য বিষাদ আসতে শুরু করে। শেষে আসে Possession যার অর্থ এই শতাব্দীতে জানে না এরকম কেউ নাই। এই সমস্ত কাজের মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল মনের involvement, মন কতটা সেখানে জড়াচ্ছে। কারোর সাথে emotionally জড়িয়ে পড়লে প্রথম যেটা ঘটে তা হল Expectation আসা। "আমি ওর জন্য এটা করেছি, ও আমার জন্য ওইটা করতে পারবে না?" এরকম ধারণা যখন পূরণ হয় না তখনই আসে Depression, ভুল বোঝাবুঝি আরো নানান সমস্যা। এরকম সমস্যা কেবল প্রেমে পড়লে হয় তা নয় বরং ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যেও এরকম ঘটতে পারে। কোনো ছাত্র যদি তার শিক্ষককে গুরু ব্যতীত পিতা বলে মনে ধারণ করে অথবা উল্টোদিকে কোনো শিক্ষক যদি তার ছাত্রকে ছাত্র অপেক্ষা পুত্র/কন্যা বলে মনে স্থান দেয় তবে তাদের মধ্যে যথাক্রমে পুত্রের ন্যায় Expectations এবং পিতার ন্যায় Expectations আসতে শুরু করে। এদেরমধ্যে একজনও যদি দুর্ভাগ্য বশতঃ তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তবে তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরা শুরু হয়ে যায়। নিজের বাবার প্রতি দায়িত্ব আর গুরুর প্রতি দায়িত্ব এক নয় - এই ধারণা Emotionally attached ব্যক্তির পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। Sentiment জিনিসটা ঠিক সেই সময় আঘাত করে মনে। প্রেমিকা তার প্রিয় বন্ধুর সাথে হেঁসে খেলে কথা বললে মনে প্রশ্ন জাগে, আমার সাথে এরকম কথা কেন বলে না? স্যারের একনিষ্ঠ ছাত্র যখন স্যারের শরীর খারাপের কথা শুনেও ফোন করে না, তখন মনে প্রশ্ন জাগে, সবই দেখনদারি ছিল, আমার কাছে পড়ার সময় কত কথা বলত, বলত স্যার সময়ে খোঁজ সবাই নেয়, আমি অসময়ে  আপনার খোঁজ নোবো, ও সব ফালতু কথা, সবাই স্বার্থপর।

এই expectation জিনিসটা যত কম থাকবে জীবনে তত সুখী হওয়া যায়। এখন প্রশ্ন হল, এটাকে কমানো কিভাবে যায়? ওই একই কথা "অভ্যাসেন তু কৌন্তেয়", অর্থাৎ অভ্যাসের দ্বারা। Emotion কে control করতে পারলেই sentiment নিয়ন্ত্রনে আসবে। তাহলে আমাকে কী সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে? মানসিক স্বছন্দতা নিয়ে কোথাও যেতে পারবোনা? নিশ্চয়ই পারবে। তবে বিশেষ কিছু মুহূর্তে নিজের আবেগকে আগলে রাখতে হবে,
ভাগবতগীতা, অধ্যায় ২ শ্লোক ৫৬,
"দুখেষবনুদ্বিগ্নমনঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ।
বীতরাগ ভয়ঃ ক্রোধঃ স্থিতধীর মুনিরূচ্যতে।।"
একই রকম ভাবে অধ্যায় ৬, শ্লোক ৭,
                                                "জিতাত্মনঃ প্রশান্তস্য পরমাত্মা সমাহিতঃ।
                                                  শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু তথামানপমানয়ঃ।। "
পাঠকের উদ্দেশ্যে এই শ্লোকদুটির অর্থ উদ্ধার করা বাড়ির কাজ হিসাবে দেওয়া থাকলো। আশা করি আপনাদের কিছুটা হলেও মনোবল বাড়বে।

Comments

Popular posts from this blog

A Poem: র দায়িত্ব-গুরুদায়িত্ব

Python Project: Finding Adjacency Matrix from a Graphic Sequence

Python Project: Havel-Hakimi Algorithm